নারায়ণগঞ্জশুক্রবার , ২৩ অক্টোবর ২০২০
  1. অর্থনীতি
  2. আরো
  3. এক্সক্লুসিভ
  4. খেলাধুলা
  5. জাতীয়
  6. নারায়ণগঞ্জ
  7. বিনোদন
  8. রাজনীতি
  9. লিড নিউজ
  10. শিক্ষাঙ্গন
  11. সারাদেশ

‘কিশোর গ্যাং’ কালচার: সমাজের ভয়াবহ এক ব্যাধি!

Alokito Narayanganj24
অক্টোবর ২৩, ২০২০ ১:১৫ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

বিশেষ প্রতিনিধিঃ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে। ছুটি গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।’ কৈশোরে ছেলেমেয়েদের আচরণ পরিবর্তিত হয়, তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। সামাজিক অবক্ষয়, সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি এবং অস্বাভাবিকতায় খেই হারিয়ে ফেলছে সমাজের কিশোর এবং তরুণেরা।

এরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে। এই কিশোরেরা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। ওই সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ সবকিছু আলাদা। বিগবস, নাইন এমএম, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ ইত্যাদি নামে গড়ে তুলছে অদ্ভূত এবং মারাত্মক ‘কিশোর গ্যাং’। যার ফলে সংঘটিত হচ্ছে নানাবিধ অপরাধ। আধিপত্য বিস্তারের নেপথ্যেত্যা, অপহরণ,ব্ল্যাক মেইলিং, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদক ব্যবসাসহ মারামারি,  পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের ভয়ঙ্কর মহড়া, মাদক এবং ইয়াবা সেবন ও বিক্রি, চাদাঁবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এমনকি খুনখারাবিসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছে ভবিষ্যত সমাজের অপার সম্ভাবনাময়ী এসকল গ্যাং-এর তরুণ এবং কিশোর সদস্যরা।

 

বিশ্লেষকরা অনেকেই বলছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে শিশু-কিশোরদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে। শহরের শিশু-কিশোররা পরিবার থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। এর ফলে তারা মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও রাজনৈতিকভাবে কিশোরদের ব্যবহার করার কারণেও তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, টিকটক এবং লাইকিতে বিভিন্ন ধরনের কিশোর গ্যাং-এর পদচারণা এবং তাদের কর্মকাণ্ড সহজেই দৃশ্যমান হচ্ছে সমাজের মানুষের নিকট।

অপরাধবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে নানান সময়ে ‘কিশোর গ্যাং’ কালচারের উত্থান এবং সমাজে বিদ্যমান কিশোর অপরাধকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সব অপরাধ সংঘটনের পেছনেই কিছু ‘ট্রিগার ফ্যাক্টর’ কাজ করে। অপরাধ বিজ্ঞানের বিভিন্ন থিওরি এই ফ্যাক্টরগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে। অপরাধী যে অপরাধ করছে তা সে অপরাধ ভেবেও করতে পারে আবার না ভেবেও করতে পারে। সাইক ও ডেভিড মাৎজা ১৯৫৭ সালে কীভাবে অপরাধী তার অপরাধকে নিউট্রালাইজড কিংবা নিষ্ক্রিয়করণ করে বিশেষ করে কিশোর অপরাধীরা নিজেকে কীভাবে সঠিক প্রমাণ করে সে বিষয়ে “নিউট্রালাইজেশন” থিওরি প্রদান করেন।

এ ধরনের অপরাধী তার কৃতকর্মের জন্য এমন সব যুক্তি দাঁড় করায় যাতে তার কোনো অপরাধবোধ বা অনুশোচনা থাকে না। সমাজে আইন মেনে চলা মানুষদের তারা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে যাতে এমন মনোভাব প্রকাশ পায় যে তারা প্রচলিত আইনকে সম্মান করে এবং তা মেনে চলার চেষ্টা করে। এই থিওরির আলোকে একজন কিশোর অপরাধী প্রথমত দায়বদ্ধতা অস্বীকার, তারপর আঘাত অস্বীকার, ভুক্তভোগীকে অস্বীকার, নিন্দুকের নিন্দা এবং উচ্চতর আনুগত্য এই পাঁচটি টেকনিকের নিরিখে নিজেকে সঠিক হিসেবে জাহির করে।

কিশোররা এই টেকনিকগুলোর আলোকে নিজের অপরাধকে প্রশমিত করার চেষ্টা করে। একজন কিশোর একটি অপরাধের সাথে যুক্ত হবার পর এমনটাই ভাবে যে এই কাজটা একদম ঠিক করেছে এবং এর কারণ বিভিন্নরকম হতে পারে। কখনো সে মনে করে, যে কাজটি সে করেছে তাতে কোনো ক্ষতিই হয়নি তাহলে অপরাধ কীভাবে হলো, কখনো মনে করে ভুক্তভোগী (ভিক্টিম) এতটাই তুচ্ছ বা ঘৃণা করার মতো যে তার ক্ষতি কোনো ক্ষতিই নয় বরং সে এর চেয়ে বেশি প্রাপ্য। কখনো যে তার বিরুদ্ধে কথা বলছে তাকেই বেশি অপরাধী বলে জাহির করে কিংবা তার এই কাজের মহৎ কোনো কারণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেকে সঠিক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে নিজেকে নিউট্রাইলাইজড বা নিষ্ক্রিয়করণ করে। যে সকল ছেলেমেয়েরা গ্যাং তৈরি করে তারা একযোগে অপরাধের সাথে লিপ্ত হয় এবং তারা সাধারণত এ ধরনের ভাবনা থেকে ও খোড়া যুক্তি দেখিয়ে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। অপরাধবিজ্ঞানে এটাও ধারণা করা হয় যে, ব্রোকেন ফ্যামিলিতে (যে পরিবারগুলিতে বাবা-মা বিচ্ছেদজনিত কারণে আলাদা থাকে) বেড়ে ওঠা কিশোরদের অপরাধ করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

কিশোর অপরাধের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত গ্যাং কালচার এবং সাবকালচার। গ্যাং কালচারের নামে পরিবর্তিত নতুন ধরনের কালচার গঠনের প্রক্রিয়াই সাবকালচার গঠনের নামান্তর। মূল সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে যখন কোনো গ্রুপ নতুন কোনো সংস্কৃতির চর্চা করে তখন সেটিকে সাবকালচার হিসেবে অভিহিত করা হয়। যাদের সংস্কৃতিতে ভাষাগত, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতায় ভিন্নতা রয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই ধরনের কিশোর গ্যাং যেমন নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ-এর কিশোরেরা এমনকি অপুদের চলাফেরা, পোশাকপরিচ্ছেদ কিংবা চুলের স্টাইল সবই আলাদা ধরনের। এসব মিলেই তারা গড়ে তুলে আলাদা কালচার এবং পরে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন ডেভিয়েন্ট ও ভায়োলেন্ট কর্মকাণ্ডের সাথে।

অপরাধ বিজ্ঞানের আলোকে এ ধরনের ডেভিয়েন্ট সাবকালচারকে (উপসংস্কৃতিজনিত বিচ্যুত ক্রিয়াকলাপ) ‘সাবকালচারাল থিওরি’ দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়। এ থিওরির একটি অংশ আলবার্ট কোহেনের ‘স্ট্যাটাস ফ্রাস্ট্রেশন থিউরি’। একজন মানুষ যখন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে জীবনযাপন করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মূল্যবোধ এবং আকাঙ্খা ধারণ করে কিন্তু জীবনে সাফল্য আনতে অপারগ হয় কিংবা বিদ্যমান সমাজের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারে তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের ফ্রাস্ট্রেশন তৈরি হয়। এই অনুভূতিই ‘স্ট্যাটাাস ফ্রাস্ট্রেশন’ (সামাজিক পদমর্যাদাজনিত প্রতিবন্ধকতা)। এর ফলে তারা নতুন মূল্যবোধ ধারণ করে নতুন সাবকালচার গড়ে তোলে। যেখানে সমাজের নিয়মতান্ত্রিক উপায়কে তারা বাদ দিয়ে সফল হবার নতুন নতুন উপায় বের করে। যেমন একজন সেলুন কর্মচারী অপু নিজেকে পরিবর্তন করে টিকটকার অপু ভাই হয়ে উঠলেন এবং যার উত্থানের নেপথ্যে ছিল ‘কিশোর গ্যাং’ নেতাদের হাত। ঠিক এভাবেই প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সব গ্যাং। ঢাকার অলিতে-গলিতে কিংবা অন্যান্য শহরে যেমন চট্টগ্রাম, সিলেট, কিশোরগঞ্জ কিংবা খুলনায় দেখা যায় অসংখ্য কিশোর গ্যাং। ফলে কিশোর গ্যাং এবং কিশোর অপরাধকে ঘিরে এক ভয়াবহ উদ্বেগ এবং আতঙ্ক ছড়াচ্ছে যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, কমিউনিটি এবং সর্বোপরি দেশের সর্বত্র।

কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে দরকার সর্বসম্মতিক্রমে সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে বেশি কারণ তাদের ছেলেমেয়ে কার সাথে মিশছে, কিভাবে বড় হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। পরিবারের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকেও নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে কিশোরদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। শিশু কিশোরদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থাকতে হবে। কিশোরদের সমাজের ইতিবাচক কাজে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। তাই এর জন্য সমাজ ও দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রাখা চাই। আগামী প্রজন্মের কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ এবং কলুষমুক্ত ও সুস্থ সমাজ গঠনে এখন থেকেই এই বিষয়ে সকলকে বিশেষ করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তৎপর এবং যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। তাহলেই গ্যাং কালচারের এই বিপথগামী তরুণদের অপরাধমুক্ত রাখা সম্ভবপর হবে এবং আগামী প্রজন্ম রক্ষা পাবে এক অসুস্থ সমাজ থেকে।

নিউজটি শেয়ার করুন...

আপনার মতামত লিখুন........

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।
error: দুঃখিত রাইট ক্লিক গ্রহনযোগ্য নয় !!!