মো. মনির হোসেন: এক সময় আব্দুর রাজ্জাককে কেউ চিনতো না। অথচ তার জন্মই হয়েছে টালিউডে। টালিউড মানে কলকাতা, তথা ভারতের চলচ্চিত্রের আঁতুর ঘর। এখানেই বেড়ে উঠেছেন উত্তম কুমার থেকে সৌমিত্র, প্রসেনজিৎ থেকে শুরু করে হালের দেব কিংবা পরমব্রতরা। টালিউডে জন্ম নেয়া আব্দুর রাজ্জাক অভিনেতা হতে চাইলেন। কিন্তু অভিনয় তো দূরের কথা, তাকে টালিউড ছাড়তে হলো ভাগ্যদোষে। তবে তিনি হতে চেয়েছিলেন খেলোয়াড়—তুখোড় গোলরক্ষক। কিন্তু হয়ে গেলেন অভিনেতা। একসময় উপাধি পেলেন ‘নায়করাজ’। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প যাঁদের হাত ধরে দাঁড়িয়েছে, তিনি তাঁদেরই একজন। গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর-আশির দশকে প্রবলভাবে তার রুপালি পর্দায় উপস্থিতি তার প্রমান।’
সিনেমায় আসার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না শৈশবে। তিনি থাকতেন কলকাতায় নাকতলায়, পড়তেন খানপুর হাইস্কুলে। ছবি বিশ্বাস, কানন দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়রা থাকতেন একই পাড়ায়। তাকে স্কুলে ফুটবলের নেশায় পেয়ে বসেছিল। ছিল গোলরক্ষক, ভালো খেলত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো স্কুলে। কবিতা আবৃত্তি করত। ছবি বিশ্বাস বিপুল উৎসাহ নিয়ে তাকে আবৃত্তি শেখাতেন।
আবৃত্তি, গান তো ছিলই। কিন্তু স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এতদিন মেয়েরাই অভিনয় করত। শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ঠিক করলেন, ছেলেদের দিয়ে নাটক করাবেন। জোগাড় করা হলো নারী চরিত্রবর্জিত নাটক বিদ্রোহী। এবার প্রশ্ন: ‘হিরো’ হবে কে? রাজ্জাক তখন দারুণ এক ফুটবল ম্যাচে গোলপোস্ট সামলাচ্ছেন। রথীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ওকে ধরে নিয়ে আয়!’
খেলার মাঠ থেকে ‘গ্রেপ্তার’ হলেন রাজ্জাক। করলেন অভিনয়। পরদিন স্কুলের কয়েকটা মেয়েও বলল, ‘তুই তো ভালো অভিনয় করিস!’
মেয়েদের প্রশংসা একটি কিশোরকে তো আপ্লুত করতেই পারে! ফলে অভিনয়ে মনোযোগী হলেন তিনি। পাড়ার শক্তিসংঘ ক্লাবে তখন নাটকের চর্চা হতো। শক্তিমান স্ক্রিপ্ট রাইটার জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী ছিলেন এই ক্লাবের নাটের গুরু। তিনি নতুন ইহুদি নামে একটি নাটক লিখলেন। পূর্ব বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যারা পশ্চিম বাংলায় এসেছিল, তাদেরই একটি পরিবারকে নিয়ে কাহিনি। পুরো সংসারের হাল ধরে একটি কিশোর ছেলে। হকারি করে, ঠোঙা বিক্রি করে, পত্রিকা বিক্রি করে। এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ডাক পড়ল রাজ্জাকের। জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী বললেন, ‘তুই আয়।’
এ নাটকটিতেও রাজ্জাক দারুণ অভিনয় করলেন। একটু একটু করে নাটকের নেশায় পেয়ে বসল তাঁকে। আশপাশের পাড়াগুলোতেও কিশোর নায়ক চরিত্রে অভিনয় করতে থাকলেন দাপটের সঙ্গে। খেলোয়াড় হওয়ার শখ ধীরে ধীরে নির্বাসিত হলো। অভিনেতা রাজ্জাক মূর্ত হয়ে উঠল।
তরুণতীর্থ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন ছবি বিশ্বাস। পীযূষ বোস ছিলেন নাট্যপরিচালক। এখানে নিয়মিত অভিনয় শুরু করলেন রাজ্জাক। অভিনয় করতে করতেই কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে। পরিবারের কেউ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাই কেউই তাঁর নেশাকে স্বীকৃতি দেননি। কেবল একজনই—মেজদা আবদুল গফুর—বলেছেন, ‘আমি আছি তোর পাশে, চালিয়ে যা!’
‘মুশকিল হলো, তাকে নিয়ে চিন্তিত পরিবারের লোকজন তাকে এ সময় বিয়ে করতে বাধ্য করলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, অভিনয় করতে গিয়ে সে বুঝি দুনিয়ার মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে। তাঁরা শর্ত দিলেন, নাটক করতে চাও করো, কিন্তু বিয়ে করতে হবে। অগত্যা, ১৯৬২ সালে সে বিয়ে করল।’ লক্ষ্মী নামের মেয়েটি রাজ্জাকের সংসারে এল লক্ষ্মী হয়েই।
‘১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ঠিক করলেন বম্বে চলে যাবে। কিন্তু ওস্তাদ পীযূষ বোস বললেন, ক্যারিয়ার গড়তে হলে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাও। কলকাতায় তাদের পরিবারের ব্যবসা ছিল, কারখানা ছিল। সচ্ছল ছিল তারা। সে খুব জেদি ছিল। ঠিক করেছিল, একেবারে মাইগ্রেশন করেই ঢাকায় চলে আসবে। সেই ভাবনা থেকেই কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে চলে এল ঢাকায়। বাপ্পা তখন আট মাসের শিশু। ঢাকার কমলাপুরে ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া করল। রোজগার বলতে কিছু নেই। টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এবার শুরু হলো সত্যিকারের জীবনসংগ্রাম।
টেলিভিশনে সংবাদপাঠক হিসেবে অডিশন দিল। পাস করল, কিন্তু অভিনেত্রী রেশমার স্বামী জামান আলী খান বললেন, “স্টপ। তুমি অভিনেতা মানুষ, তুমি কেন খবর পড়বে?”
তিনি ডিআইটিতে নিয়ে গেলেন। তখন একটি ধারাবাহিক নাটক হতো ঘরোয়া নামে। আনোয়ারা বেগম, শিমূল বিল্লাহ (এখন ইউসুফ), লালু ভাই অভিনয় করতেন। সেও, সে নাটকের লোক হয়ে গেল। কিন্তু সংসার তো চলে না।’
ততদিনে ফার্মগেটে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন রাজ্জাক। হেঁটে হেঁটে ফার্মগেট থেকে ডিআইটি টেলিভিশন ভবনে যান। আট আনা, এক টাকা বাঁচে, সেটাই অনেক। কিন্তু তখন টিকে থাকা ছিল খুব কঠিন। কিন্তু লক্ষ্মী ছিল পাহাড়ের মতো অটল। ও বলেছিল, চেষ্টা করো। ওর কারণেই রয়ে গেল সে। যুদ্ধ ঘোষণা করল, আমাকে কিছু একটা করতেই হবে।’
কাজী জহির, মুস্তাফিজ, সুভাষ দত্তদের কাছে যান রাজ্জাক। অনুরোধ করেন, ‘একটা চরিত্র যদি দেন’ সবাই শোনেন। রাজ্জাক বলেন, ‘নাটকের ওপর কাজ করেছি। বম্বের শশধর মুখার্জির ফিল্মালয় থেকে নয় মাসের কোর্সও করেছি। ছোটখাটো একটা পার্ট যদি দেন, হিরো হতে চাই না। চাই যেকোনো একটি চরিত্র’ কার বউ, ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন ইত্যাদি সিনেমায় মিলতে থাকে ছোটখাটো কাজ। কিন্তু সেটা টিকে থাকার মতো যথেষ্ট কিছু নয়।
এরই মধ্যে জহির রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ হতেই জহির বলেন, ‘আপনি তো এখানকার মানুষ নন। কোত্থেকে এসেছেন?’ রাজ্জাক বলেন, ‘কলকাতার।’
ঝটপট জহির বলেন, রোববার সকালে ঘুম থেকে উঠে সোজা আমার কায়েতটুলির বাড়িতে চলে আসবেন। চুল-টুল আঁচড়াবেন না। ঘুম থেকে উঠে সোজা—বুঝেছেন?’ রাজ্জাক রোমাঞ্চিত হন। কথামতো কায়েতটুলিতে যাওয়ার পর খুশি হন জহির। বলেন, ‘আমি আপনাকে নায়কের পার্ট দেব।’
রাজ্জাক আকাশ থেকে পড়েন। আস্তে আস্তে জানতে পারেন, জহিরের নিজের লেখা উপন্যাস হাজার বছর ধরে থেকে ছবি বানাচ্ছেন তিনি। সেখানে মূল চরিত্রটি তিনি রাজ্জাককে দিতে চান। কিন্তু সে সময়ই জহিরেরও কী সব ঝামেলা হলো। ছবিটি আর করা হলো না। দিশেহারা হয়ে পড়লেন রাজ্জাক।
কেটে গেল বেশ কিছু দিন। এর মধ্যে একদিন মোহাম্মদ জাকারিয়ার সঙ্গে দেখা। সেই জাকারিয়া, যিনি শম্ভু মিত্রের বহুরূপীর সদস্য ছিলেন। বললেন, ‘জহির রায়হান আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।’
জহির রাজ্জাককে দেখেই বলে উঠলেন, ‘আপনার বাড়ি চিনি না। কেউ ঠিকানা দিতে পারছে না! আর আপনাকে আমি হিরো করে রেখেছি!’ তখনই সাইনিং মানি বাবদ পেলেন ৫০০ টাকা। সেখানেই মিষ্টিমুখ করালেন ইউনিটের সবাইকে। বাকি টাকা লক্ষ্মীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমি জহির রায়হানের ছবিতে “হিরো” হয়েছি।’
ছবিটির নাম ছিল বেহুলা। পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন ছবিটি করে। এরপর আগুন নিয়ে খেলা করার সময় তিনি নিলেন সাত হাজার টাকা। এটা সেই সময়ের কথা বলা হচ্ছে, যখন একটি বড় মোরগ পাওয়া যেত দেড় টাকায়!
ষাটের দশকটা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবোধে জাগ্রত হওয়ার দশক। চলচ্চিত্র থেকেও উর্দুর দাপট কাটিয়ে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার দশক। রাজ্জাক ছিলেন সে আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ সৈনিক। বেহুলা থেকেই রাজ্জাককে চিনে নিল দর্শক। বাংলা ছবিও যে দর্শককে টেনে নিয়ে যেতে পারে সিনেমা হলে। তা প্রমাণিত হলো। প্রস্তাব পেলেও রাজ্জাক কখনো উর্দু ছবিতে অভিনয় করেননি। এরপর আগুন নিয়ে খেলা, আবির্ভাব, এতটুকু আশা, কাচ কাটা হীরা, অশ্রু দিয়ে লেখা দিয়ে পৌঁছুলেন জীবন থেকে নেয়া ছবির কাছে। ততদিনে রাজ্জাক এক নম্বর তারকা।
জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া ছবিটি ঘিরে অনেক স্মৃতি রাজ্জাকের।
স্বাধীনতার পর ওরা ১১ জন, অবুঝ মন, ময়না মতি, মধু মিলন, রংবাজ করেছেন। এরপর আলোর মিছিল ছবিটি ছিল ব্যতিক্রমী। বাদী থেকে বেগম, গুন্ডা, মায়ার বাঁধন, মতি মহল, আসামী হয়ে তিনি পাড়ি দিলেন অনেকটা পথ—একেবারে অনন্ত প্রেম পর্যন্ত। এই ছবিটি পরিচালনাও করলেন রাজ্জাক। অগ্নিশিখা, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা…ছবির পর ছবি করে যেতে লাগলেন। মাঝে মাঝে পরিচালনাও করলেন। বাবা কেন চাকর, মরণ নিয়ে খেলা তাঁর পরিচালনায় আরো দুটি ছবির নাম। রাজ্জাক-নির্মিত ছবিগুলো ছিল সুস্থধারার। চলচ্চিত্র জগতে যখন অপসংস্কৃতি ধীরে ধীরে বাসা বাঁধতে শুরু করল, তখনো রাজ্জাক নিরলসভাবে সুরুচিসম্পন্ন ভালো বাণিজ্যিক ছবি করে যেতে থাকলেন। এরই মধ্যে সুচন্দা, কবরী, শাবানা, ববিতা, রোজিনার সঙ্গে একের পর এক সফল জুটি উপহার দিয়ে গেলেন প্রায় ৪০০শত ছবি।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকারের বলেছিলেন, কী ইন্ডাস্ট্রি বানিয়েছিলাম আমরা, আর কী হয়ে গেল সেটা! কেন যেন মনে হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে আমাদের। এটা একেবারেই ভালো লাগে না। আমি চাই, বাংলাদেশের বাংলা চলচ্চিত্র আবার একটা উচ্চতায় পৌঁছাবে।’ রাজ্জাক একটি সুস্থধারার উন্নত রুচির চলচ্চিত্রশিল্পের স্বপ্ন দেখতেন।
একনজরে
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
* কি যে করি (১৯৭৬)
* অশিক্ষিত (১৯৭৮)
* বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২)
* চন্দ্রনাথ (১৯৮৪)
* যোগাযোগ (১৯৮৮)
* আজীবন সম্মাননা ২০১৩
মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০১৪
বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেতা নায়ক রাজ রাজ্জাক ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। কিংবদন্তী এই অভিনেতা ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারতের কলকাতার জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আব্দুর রাজ্জাক।
সূত্র ইন্টারনেট।
আপনার মতামত লিখুন........