নারায়ণগঞ্জসোমবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
  1. অর্থনীতি
  2. আরো
  3. এক্সক্লুসিভ
  4. খেলাধুলা
  5. জাতীয়
  6. নারায়ণগঞ্জ
  7. বিনোদন
  8. রাজনীতি
  9. লিড নিউজ
  10. শিক্ষাঙ্গন
  11. সারাদেশ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় ও কিছু কথা

Alokito Narayanganj24
ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৯ ৯:২৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

রণজিৎ মোদক : বেদে সাধারণভাবে বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত একটি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠী। কথিত আছে যে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকানরাজ বল্লাল রাজার সাথে এরা ঢাকায় আসে। পরবর্তীকালে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। এরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে এবং পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও তারা ছড়িয়ে পড়ে। বেদের আদি নাম মনতং। বেদে নামটি অবজ্ঞাসূচক বাইদ্যা (হাতুড়ে ডাক্তার), পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ (চিকিৎসক) থেকে উদ্ভূত। অধিকাংশ বেদেই চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী (Mon-tong) গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। তাই এরা নিজেদের মনতং বলে পরিচয় দিতে বেশি আগ্রহী। যুদ্ধ ও শিকারে অতিশয় দক্ষ বেদেরা কষ্টসহিষ্ণু ও সাহসী। এদের গাত্রবর্ণ ও আকৃতি বাঙালিদের মতোই।

“আমরা এক ঘাটেতে রান্দি বারি, আর এক ঘাটেতে খাই- আমাদের সুখের সীমা নাই।”- এ গানের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছেনা বেদে সমাজ। বহু যুগ পরে নাগরিকত্ব লাভ করে ভোটাধিকার পেয়েছে বেদে পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ে তারা সরকারের পক্ষ থেকে কোনরূপ সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছে না। পাচ্ছে না বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এমনকি ঈদ আনন্দের দিনে সরকারী অনুদান। পাচ্ছেনা শিক্ষার সুযোগ।

বেদে-বেদেনী, সাপ-সাপিনীকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যের জগত অনেকাংশ দখল করে আছে। যাযাবর জীবন বেছে নিলেও এদের একটি সমাজ রয়েছে। বিচিত্র সমাজ রীতিনীতি সত্যি অদ্ভুত। সহজ সরল জীবনযাপন, অল্প এদের চাহিদা। এরা দলবদ্ধভাবে জীবনযাপন করে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে অধিকাংশ বেদে পরিবার নৌকায় বসবাস করে। তবে ইদানিং এই বেদে পরিবারের সদস্যরা অনেক স্থানেই বসতঘর নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে দেখা যায়। অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করে জীবন জীবিকার তাগিদে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে।

বর্তমান সরকার তাদের নাগরিকত্ব দান করলেও তারা সরকারী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কেরাণীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগাঁও ও পানগাঁও তীর ঘেষে বেশ কিছু বেদে পরিবার দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করছে। এদের বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন মুন্সীগঞ্জ এলাকায় বসবাস করছে। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৪ থেকে ৫ লাখ বেদে বসবাস করছে। এদের অনেকেই আদি পেশা বাদ দিয়ে বিভিন্ন পেশার কাজ কর্ম করে জীবন যাপন করছে। বেদে পরিবারের সদস্য সরদারনী পারুল ও তার স্বামী রহমত উল্লাহর সাথে কথা বলে জানা যায়। বেদেদের মধ্যে ৪ শ্রেণী রয়েছে। এক শ্রেণী মাছ শিকার করে। অপর এক শ্রেণী সাপ খেলা ও গাছ-গাছড়া বিক্রি করে। বেদে নারীরা কাঁচের চুড়ি ফিতা বিশেষ করে গেরস্থ পরিবারদের চাহিদা মাফিক স্বল্প মূল্যের প্রসাধনী ও শিশুদের খেলনা বিক্রি করে। আর একটি শ্রেণীর মহিলারা বাত ব্যাথার চিকিৎসার নামে ঝারা ফুঁক ও সিংগা লাগিয়ে থাকে। এছাড়াও তারা দাঁতের পোক খশানী…………..

সাপ খেলায় নারী-পুরুষ উভয়দেরকেই দেখা যায়। তবে বেদেদের মধ্যে আরও এক শ্রেণী দেখা যায়। তারা পোক পাখালী শিকার করে। এ কাজ সাধারণত পুরুষরাই করে থাকে। যারা ভোজবাজীর খেলা দেখিয়ে টাকা পয়সা রোজগার করে তারা নিজেদেরকে কামরূপ কামাক্ষার (কোচার) থেকে মন্ত্র শিক্ষাপ্রাপ্ত বলে দাবি করে থাকে। ভোজবাজীর খেলায় নারী-পুরুষ দুই শ্রেণী রয়েছে।

বেদে সম্প্রদায় নামাজ রোজা করেন। তবে তারা বিষ খশানী মন্ত্রে বিশেষ করে তারা সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় মা মনসার গান গেয়ে থাকেন। তারা মা মনসা বা পদ্মা দেবীকে যথেষ্ট মান্য করে। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসার নামে দুধ কলা ভোগ দিয়ে থাকে। বেদে সম্প্রদায়ের যারা মন্ত্রতন্ত্র সিদ্ধ তারা অনেকে উদক্ষের মালার সাথে বিভিন্ন রঙের পাথর মালা ব্যবহার করে। এরা নীলা, পোকরাজ বিভিন্ন পাথর বিক্রি করে।

দশ-বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ বা তারও অধিক পরিবার নিয়ে একটি করে দল গঠিত হয়। প্রত্যেক দলের একজন করে দলনেতা বা সরদার রয়েছে। যেকোন দরবার সালিশে সরদারের সিদ্ধান্তই সিদ্ধান্ত। সরদারের মতের বাহিরে কেউ কোন কাজ করলে, তাকে শাস্তি পেতে হয়। বেদেরা সাধারণত তাদের সরদারকে রাজার সম্মান দিয়ে থাকে। তবে বেদে সম্প্রদায় যাযাবর হলেও তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এখানে কথা হচ্ছে আমাদের দেশের বাহিরে বিশেষ করে ভারতে যে সব বেদে, কোচ, সাওতাল সম্প্রদায় রয়েছে। তাদের কথা অন্য। তারা সেই দেশের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। বেদে নারীরা ২/১জন করে দল বেঁধে বেশ সেজে-গুজে মাথায় বেত অথবা বাশের ঝুড়ি নিয়ে চুড়ি বেচতে যায়। এই বেদে নারী-পুরুষের কথার মধ্যে একটা টানা সুর লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে নদীর তীরে যাদের বসবাস তাদের গলার সুর বেশ টানা হয়ে থাকে। শুধু বেদে নয় পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া এলাকার মানুষদের কন্ঠেও টানা সুর। ভৌগলিক কারণ বলেই ভাষাবিদরা এ মন্তব্য করেন। বেদেরাও যেহেতু বার মাস নদীতে নৌকায় বসবাস করে তাই তাদের গলার টানা সুর বিরাজ করে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বেদে সম্প্রদায়ের বিয়ে। বাবা-মা বা মুরব্বীরা বর-কনে পছন্দ করে। সামাজিকভাবে নদীর তীরে আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বর গিয়ে উচু গাছে উঠে বসে থাকবে। কিছুতেই বাসর ঘরে যাবে না। তখন কনে (বৌ) সেই গাছের নিচে গিয়ে বরকে গাছ থেকে নামার জন্য মিনতি করবে। তাতেও বর গাছ থেকে নামবে না। কনে (বৌ) তখন বলবে আমি রোজগার করে তোমাকে খাওয়াবো তুমি গাছ থেকে নেমে আসো। তিন সত্য করে কনে তার বরকে গাছ থেকে নামাবে। বর গাছ থেকে নামার পর কনে পক্ষ সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবে।

বিয়ের পর বরের বাবা-মা তাদের ছেলেকে পৃথক একটি নতুন নৌকা দান করবে। এই নৌকাই তাদের বাসর ঘর এই নৌকাই তাদের রাজ্য। এর মধ্যে নৌকার পিছন কনের সীমানা, সামনের অংশ বরের সীমানা। এই স্ব স্ব সীমানায় এক একজনের অধিকার। কেউ কারো সীমানায় এসে কাউকে কেউ আঘাত করতে পারবে না। নৌকার মাঝখান ছৈয়ার নীচে তাদের বাসর। দৈবাৎ বেদে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া বিবাদ হলে অন্য নৌকার কেউ ফেরাতে আসবে না। স্বামী-স্ত্রীর শরীরে আঘাত করলে সরদারের কাছে বিচার দিতে পারবে। স্বামী যদি স্ত্রীর সীমানায় গিয়ে স্ত্রীকে মারধর করে তাহলে স্বামী অপরাধী বলে গন্য হবে। অথবা স্ত্রী যদি স্বামীর সীমানায় গিয়ে স্বামীকে আঘাত করে তবে স্ত্রী অপরাধী বলে গণ্য হবে।

বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষার নাম ঠেট বা ঠের। স্বগোত্রীয়দের সাথে কথা বলার সময় এরা এই ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলা-ভাষাভাষীর সাথে এরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, এই ঠেট ভাষার সাথে আরাকানিদের ভাষার প্রভূত মিল আছে। তাদের ভাষায় ব্যবহৃত অধিকাংশ শব্দই বাংলা ভাষার আদিরূপ প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত।

বাংলাদেশের বেদেরা এদেশেরই নাগরিক। ভোটাধিকারসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা তাদের প্রাপ্য। বাংলাদেশে এরা বরাবরই ক্রমহ্রাসমান একটি জনগোষ্ঠী। সময়ের পরিবর্তনে বেদেদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষা ও অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে পেশা বদল করছে বা অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে স্বকীয় কৌম পরিচয় হারিয়ে ফেলছে।

লেখক-
রণজিৎ মোদক
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব।

নিউজটি শেয়ার করুন...

আপনার মতামত লিখুন........

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।
error: দুঃখিত রাইট ক্লিক গ্রহনযোগ্য নয় !!!