কামাল সিদ্দিকী : রমজান চন্দ্র বর্ষের দশম মাস। চন্দ্র মাসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মহিমান্বিত মাস হিসেবে এ মাস স্বীকৃত। কারণ এ পবিত্র মাসে মুসলমানগণ তাকওয়া অর্জনের লক্ষে সিয়াম সাধনা করে থাকে। সর্বোপরি পবিত্র কোরআন এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে বলে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন সুরা কদরের মাধ্যমে আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ (সাঃ) তথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। এছাড়া এ মাসের শেষ দশদিনের কোন একটি বেজোড় রজনিকে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলে ঘোষনা করেছেন।
পবিত্র রমজান মাসের প্রথম দশ দিন রহমত, দ্বিতীয় দশদিন মাগফিরাত ও তৃতীয় দশদিন নাজাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মাসের মর্তবা সম্পর্কে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, এ মাসের শুরুতেই শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়। জাহান্নামের আজাব স্থগিত করা হয় এবং জান্নাতের দরোজা খুলে দেওয়া হয়।
এ মাসকে কিতাব নাযিল এর মাস হিসেবে অভিহিত করা যায়। কারণ মারেফুল কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে হযরত ওয়াসেলা ইবনে অসকা থেকে রেওয়ায়েত করা হয়ে যে, রাসুল করিম (সাঃ) বলেছেন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সহীফা রমযান মাসের পহেলা তারিখে নাযিল হয়েছিল। আর রমযানের ৬ তারিখে তাওরাত, ১৩ তারিখে ইজ্ঞিল, যাবুর রমযানের ১২ তারিখে আর পবিত্র কুরআন কদর রাতে নাযিল হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতুল ক্বাদরি অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি উহা কদর রাতে নাযিল করেছি। (সুরা কদর) সুরা বাকারায় বলা হয়েছে, ‘শাহরু রমদানাল্লাজি উনযিলা ফিহিল কুরআনু হুদালিন্নাসি ওয়া বায়্যিনাতিল হুদা ওয়াল ফোরক্বান।’ অর্থ: রমযান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন , যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য ন্যায় -অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।
অর্থাৎ রমযান এক মহিমান্বিত মাস। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি সাওয়াবের আশায় ঈমানের সাথে রমযানের রোযা রাখবে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। হাদীসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন, ‘রোযা ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে রোযা আমার জন্য। আমি নিজে এর পুরস্কার দিব। স্বাভাবিক মাসের সওয়াব অপেক্ষা রমজানের সওয়াব ৭০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
রমযান মাসকে এত মহিমান্বিত করার মূল কারণ হচ্ছে বান্দার সিয়াম সাধনা। কেননা সিয়ামের মাধ্যমে আত্মাকে বিশুদ্ধ করা যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, হে ঈমানদারগণ আমি তোমাদের উপর রোযাকে ফরজ করেছি । যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সুরা- বাকারা ১৮৩ আয়াত)।
উপযুক্ত আয়াতে রোযার আরবি পরিভাষা ’সিয়াম’ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ বিরত থাকা এবং সর্বশেষ শব্দে ’তাত্তাকুন বা পরহেযগার’ বলা হয়েছে । যে দু’টি শব্দের তাত্তিক অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত যা ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে এ কথা বলা যেতে পারে যে বিরত থাকা বলতে শুধু পানাহার ও যৌনতা হতে বিরত থাকা নয় । বরং রমযান মাসে তো অবশ্যই; রমযান পরবর্তী মাসেও যাবতীয় খারাপ-অশ্লীল কাজ হতে বিরত থাকতে হবে।
কারণ, ইমানের মূল বাক্যের শুরুতে যে, ‘লা’ অর্থাৎ না বাচক মনোভাব মানব মনে দানা বাধে তার বাস্তব রূপায়ণই হলো রমজান মাসের রোযা বা সিয়াম। লা ইলাহা এর এই ’লা’ এবং রমযানের ‘সিয়াম’ এক অর্থে পরস্পরের পরিপূরক শব্দ । কারণ ‘লা’ এর দ্বারা সকল ভ্রান্ত অলিক -ফাঁকি মতবাদকে অস্বীকার করা হয়েছে। আর সিয়াম দ্বারা যাবতীয় খারাপ-ভ্রান্তচিন্তা-চেতনা-কর্ম থেকে বিরত থাকার প্রশিক্ষণ নিতে বলা হয়েছে।
কেননা পবিত্র হাদীস শরীফে আল্লাহর নবী (সঃ) বলেন, রোযা রেখেও কেউ যদি মিথ্যা কথা বলা ও তদনুরূপ কাজ পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই ।
নিজের মনকে কু চিন্তা হতে বিরত রাখা, নিজের চোখকে যাবতীয় অশ্লীলতা হতে বাঁচিয়ে রাখা, নিজের কানকে কু-শ্রবণ হতে রক্ষা করা, নিজের হাতকে অপরের ধন-সম্পদ, সুদ-ঘুষ ও পরনারীর স্পর্শ হতে বিরত রাখা এবং নিজের পদযুগলকে কুপথগামী না করাটাও সিয়ামের মূল কথা। পবিত্রকুরআনে সূরা ইয়াসিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, আল ইয়াওমা নাখতিমু আ’লা আফঅহিহিম অতুকাল্লিমুনা আইদিহিম অতাশহাদু আর জলুহুম বিমা কানু ইয়াকসিবুন।-অর্থাৎ আমি আজ এদের মুখে মোহর করে দেব, এদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং এদের চরণ এদের কৃতকমের্র সাক্ষ্য দেবে।”
সুতরাং, বলা যায় শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ -প্রত্যঙ্গই তার কৃতকর্মের জবাবদীহি করবে তাই যাবতীয় ইনটেনশন ও ইন্দ্রিয়গুলোকে পাপকর্ম থেকে বিরত রাখা সিয়ামের অন্যতম শিক্ষা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কিভাবে স্বীয় অঙ্গ -প্রত্যঙ্গ দ্বারা খারাপ কাজ করা ও মন্দ চিন্তা হতে মন-মস্তিস্ককে বিরত রাখা যায়? রোযা ফরজ হওয়ার আয়াতের শেষ শব্দে এর উত্তর বলা হয়েছে। আর তা হলে তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে।
তাকওয়া আরবী শব্দ। এর অর্থ খোদাভীতি অর্জ করা। একমাত্র সার্বিক পরিস্থিতিতে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনকে হাজির-নাজির জানার মধ্যেই এ তাকওয়া অজর্ন করা যেতে পারে।
কারণ, আল্লাহপাক পবিত্র কোরাআনে বলেছেন, ‘‘আল্লাজিনা ইয়াজকুরুন্নাল্লহা কিয়ামাঁও অ কু’উদাঁউ, অ আ’লা জুনুবিহিম অ ইয়া তাফাক্কারুনা ফি খালকিস সামাওয়াতি অ-অল আরধি। (আল ইমরান ১৯১ আয়াত) । অর্থাৎ যারা দাঁড়িয়ে বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে। এভাবে যারা সাবির্ক অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাকে ভয় করে । তারা কখনো অন্যায় কাজ বা পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে না।
আর পবিত্র মাহে রমযানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই এই তাকওয়ার গুণ অর্জন হতে পারে। আর সামষ্টিকভাবে প্রকৃত তাকওয়ার গুন ধারণ করার মাধ্যমে একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ বির্নিমান করা যেতে পারে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন আমাদের বিশুদ্ধ রোযা পালনের মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভের তাওফিক দিন।
লেখক-
কামাল সিদ্দিকী, কবি ও কলমিস্ট।
আপনার মতামত লিখুন........