মোঃ মনির হোসেন: একট সময় ছিল এই সমাজে ছোটখাটো অপরাধ, ঝগড়া-বিবাদ বা কোনো অনাচার হলে স্থানীয় মুরব্বিরা পঞ্চায়েত কমিটির মাধ্যমে বিচারসভা বসাতেন। বিবেকবান মুরব্বিরা পারিবারিক–সামাজিক সংকটগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান করে দিতেন। এখন তেমন ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ তো নেই, বরং যা আছে সেখানে গোষ্ঠী, পরিবার, দলপ্রীতির সভা হয়। ক্ষমতাবানেরা পার পেয়ে যায়, প্রশ্রয় পায়। দুর্বলদের ওপর শাস্তি বা বদনাম দেওয়া হয় । অথবা বিচারের নামে অবিচার করা হয়, সালিসের নামে, ফতোয়ার নামে দুর্বলদের ওপর অমানবিক শাস্তি দেওয়া হয়। সবই হয় ‘ক্ষমতার’ ইকুয়েশন বিবেচনা করে।
দ্বিতীয়ত, চোখের সামনে অপরাধ ঘটলেও কেউ এগিয়ে আসেন না প্রতিরোধ করতে, কেউ আসেন না ভয়ে নিজে আক্রান্ত হবেন বা পরে টার্গেট হবেন—এই আশঙ্কায়, কেউ ভয় পান পুলিশের ঝামেলার কথা মনে করে, দু–একজন সাহস করে এগিয়ে এলেও তার খেসারত দিতে হয় বিভিন্নভাবে। হত্যা–খুন আগেও হতো, তবে তখন তা হতো গোপনে, নির্জনে বা ভাড়াটে খুনি দিয়ে। অপরাধীরা প্রকাশ্য হতে ভয় পেত। পুলিশে ধরবে, গণপিটুনি খাবে, চিহ্নিত হলে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হবে। কিন্তু এখন চিত্র পুরো উল্টো হয়ে গেল কেন? সাধারণ মানুষ কেন অপরাধ প্রতিরোধে এগিয়ে আসে না? মহামান্য হাইকোর্ট পর্যন্ত বলছেন, এটি সমাজের ব্যর্থতা। কেন সমাজ ব্যর্থ হচ্ছে?
আগে সমাজপতিরা নিজের দায়বদ্ধতা থেকে সমাজের অপরাধগুলির সমাধান করতেন, তারা ভাবতেন এটা আমাদের কর্তব্য, তবে এখন যারা সমাজ পরিচালনা করছেন তারা ঠিক তার উল্টো, ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ বিশেষ করে তারা খুব সহজেই পুলিশের দ্বারস্থ হয়, তারা থানার উপর নির্ভরশীল হয়েই সমাজ পরিচালনা করছেন।
বর্তমানে সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি এবং অস্বাভাবিকতায় খেই হারিয়ে ফেলছে সমাজের কিশোর এবং তরুণেরা।এরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে। এই কিশোরেরা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। ওই সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ সবকিছু আলাদা। বিগবস, নাইন এমএম, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ ইত্যাদি নামে গড়ে তুলছে অদ্ভূত এবং মারাত্মক ‘কিশোর গ্যাং’। যার ফলে সংঘটিত হচ্ছে নানাবিধ অপরাধ। আধিপত্য বিস্তারের নেপথ্যে মারামারি, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের ভয়ঙ্কর মহড়া, মাদক এবং ইয়াবা সেবন ও বিক্রি, চাদাঁবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এমনকি খুন খারাবিসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছে ভবিষ্যত সমাজের অপার সম্ভাবনাময়ী এসকল গ্যাং-এর তরুণ এবং কিশোর সদস্যরা।
তাহলে দেশের ভবিষ্যত বংশধররা এখন কোন পথে যাচ্ছে? বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, ব্রেকআপ, লিভ টুগেদার শব্দগুলো বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় খুব বেশি দিনের নয়। বিগত এক দশকে এ শব্দগুলো বাংলাদেশের শহুরে নাগরিক সমাজে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, আইন-কানুন, বিধিবিধান কোনো কিছুই সামাজিক সংস্কৃতির ইত্যাকার শব্দগুলোকে সমর্থন না করলেও এর বিস্তৃতি ঘটছে দ্রুত গতিতে। ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির এই ধারার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এর ক্রমবর্ধমান বিকাশে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধের সংঘাত তৈরি হচ্ছে তাতে পুরো সমাজব্যবস্থায় ছড়িয়ে যাচ্ছে অবক্ষয়, বিকশিত হচ্ছে অপরাধের সংস্কৃতি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ!
সম্প্রতি এক মায়ের আকুতি ‘আমার ছেলেকে কেন জানে মারল। পঙ্গু করে দিলেও তো আমার বুক আগলে থাকত,’ রিফাতের মায়ের এই অসহায় আকুতি প্রমাণ করে, আমরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দূরের কথা, তাদের কাছে নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার পরিবেশে বাস করছি। এতই অসহায় যে বলছি, তোমরা জানে মেরে ফেলো না, পঙ্গু করে হলেও কোনো রকমে বাঁচিয়ে রেখো।
গুম হয়ে যাওয়া মা-বাবারাও আবেদন করে যাচ্ছে আমাদের সন্তানের লাশটুকু অন্তত ফেরত দাও।
কেন সমাজ এমন হলো? একটি জীবন্ত, প্রাণবন্ত, মানবিক সমাজের তো এমন হওয়ার কথা নয়। প্রশ্নের উত্তর যেমন জানতে হবে, একে বদলানোর উপায় বের করা আরও জরুরি।
মোটা দাগে সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা, দুর্বল কাঠামোর শিক্ষানীতি এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতাকেই এই কিশোর গ্যাং নামক সামাজিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে গণ্য করছেন। কালের আবর্তনে আমাদের সামাজিক অবক্ষয় দৃশ্যমান। এক সময় আমাদের সমাজে মূল্যবোধের চর্চার ঐতিহ্য ছিল। সমাজে ‘মুরব্বি’ সংস্কৃতির চর্চা ছিল। পাড়ার বয়স্কদের ছোটরা সম্মান করত। দূর থেকেই সালাম দিত, হাতে সিগারেট থাকলে ফেলে দিত। অন্যায় করতে দেখলে বড়রাও ছোটদের শাসন করত। ছোটরা বেয়াদবি করলে বড়রা এগিয়ে এসে বিচার সালিশ বসাত। সেই ঐতিহ্য আজ ভেঙে পড়ছে। মুরব্বিরা ভীত, কিশোর-তরুণরা বেপরোয়া। সামাজিক সেই বন্ধন ও শৃঙ্খলা খসে পড়েছে। বাবা-মায়েরা পেশা ও ব্যবসায় টাকা রোজগারে ব্যস্ত। সন্তানদের স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদি দেখার সময় তাদের নেই? তা ছাড়া ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা, দ্বন্দ্ব-কলহ এবং পরিবারে ভাঙনের কারণে সন্তানরা সহজেই বিপথগামী হয়ে পড়ছে।
কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে দরকার সর্বসম্মতিক্রমে সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে বেশি কারণ তাদের ছেলেমেয়ে কার সাথে মিশছে, কিভাবে বড় হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। কিশোরদের সমাজের ইতিবাচক কাজে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। তাই এর জন্য সমাজ ও দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রাখা চাই। আগামী প্রজন্মের কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ এবং কলুষমুক্ত ও সুস্থ সমাজ গঠনে এখন থেকেই এই বিষয়ে সকলকে বিশেষ করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তৎপর এবং যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। সব ধরনের অন্যায় ও পঙ্কিলতা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রেখে আগামীতে সবার জন্য একটি সুন্দর জীবনমান সৃষ্টির লক্ষ্যে কালবিলম্ব না করে এসব জটিল সামাজিক সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়াটার ওপর আমাদের সার্বিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
আপনার মতামত লিখুন........