মো. মনির হোসেন : চীনের উহান প্রদেশে এই করোনা আক্রমণের শুরু থেকে কেউ কি ভাবতে পেরেছিল এই ভয়াবহ পরিণামের কথা? বিশ্বের অনেক মহাশক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রনায়করা চীনের এই ভাইরাসকে উপহাস ও অবজ্ঞা করে ব্যাঙ এবং কুটূক্তিও করতে ছাড়েনি। এখন কী ঘটছে সেসব দেশে? করোনার ছোবলে গোটা পৃথিবী এখন থরকম্প। পৃথিবীর ১৯৯টি দেশ ও অঞ্চল এখন বিচ্ছিন্ন। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া এমনকি আফ্রিকা মহাদেশ ‘লকডাউনে’। বন্ধ সব কল-কারখানা। জল, স্থল ও আকাশ যোগাযোগও বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেছে আমদানি-রফতানি। ঘরবন্দি হয়ে রয়েছে বিশে^র কোটি কোটি মানুষ। ভয় ও আতঙ্কে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ব, আঞ্চলিক ও দেশীয় অর্থনীতি। পৃথিবীর এমন চিত্র কোনো দিন কেউ দেখেনি। ইতিহাসেও বোধহয় এমন নজির নেই।
এমনই যখন অবস্থা তখন ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় করোনা রোগী। ১২ মার্চ করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এক বৃদ্ধের। আতঙ্ক ও শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। সরকার নজিরবিহীনভাবে সংকুচিত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সব অনুষ্ঠান। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের সব অনুষ্ঠানও স্থগিত করা হয়। বাতিল করা হয় ২৬ মার্চের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলো। করোনা মোকাবেলার বিভিন্ন প্রস্তুতি হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ঘোষণা করা হয় দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি। তবে ছুটি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন। ফলে ৯ এপ্রিল যেহেতু বৃহস্পতিবার আর পরবর্তী দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে ১১ এপিল, পরে বর্ধিত হয়ে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি থাকবে। চিকিৎসা সেবাসহ জরুরি সেবা সংস্থা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ। ছুটি ঘোষিত হয় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রায় সব গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল কারখানাসহ বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশব্যাপী নামানো হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। পুলিশ টহল দিচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী শহর পর্যন্ত। এমতাবস্থায় বলা যায়, দেশে চলছে এখন ‘লকডাউন’ বা বন্ধ। রাজধানী ঢাকাসহ শহর ও গ্রামের এমন বিবর্ণচিত্র কেউ কোনোদিন দেখেনি-কল্পনাও করেনি।
এমনই এক বাস্তব অবস্থায় নজিরবিহীন মহাসংকটে পড়েছে দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র, অনলাইন শিল্প। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইতালি ও স্পেনসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে (বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায়) অনেক সংবাদপত্রের মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশেও কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা ছাপা বন্ধ রেখেছে। রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটের হকার-এজেন্টরা পত্রিকা বিলিবণ্টন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকার অধিকাংশ হকার, এজেন্ট ও বিট পিয়ন হয় গ্রামের বাড়ি গেছে, না হয় ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তার পরও দেশের এই জরুরি ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় পাঠকের কাছে সংবাদ পরিবেশন করা যেমন সংবাদ মাধ্যমগুলোর দায়িত্ব, তেমনি সেই সংবাদপত্র পাঠকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে কি-না, সেটি দেখার দায়িত্বও তাদের। এই সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত সেই সাংবাদিক, সংবাদকর্মী, প্রেস শ্রমিক, হকার, এজেন্ট-সবাই তো মানুষ। তাদেরও জীবন আছে, পরিবার-পরিজন আছে, আছে ভয়-ভীতি ও রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও। তার পরও দেশের এই দুঃসময় ও ক্রান্তিলগ্নে নিবেদিত প্রাণ গনমাধ্যম কর্মীরা অত্যন্ত দৃঢ় মনোবল, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ, অঙ্গীকার এবং সেবার মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহসের সঙ্গে ঝুঁকির মধ্যেও সংকুচিত পরিসরে হলেও পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ও পেশাজীবী একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে দেশের এই অবস্থায় জীবনের ঝুঁকির মধ্যে দায়িত্ব পালনরত ওইসব সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীকে অভিবাদন ও শ্রদ্ধা জানাই।
কিন্তু পত্রিকার পাঠক কোথায়? কে কার কাছে কীভাবে পত্রিকা পৌঁছাবে? কোনো মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। বহু জায়গায় হকার ও বিট পিয়নদের বাসা-বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ‘সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না।’ তবুও কিছু কিছু মানুষের মনে এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ভয়ে অনেকে পত্রিকা ধরতে চান না। এ অবস্থায় একদিকে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস, আদালত, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিজ্ঞাপন এখন শূন্যের কোঠায়। অন্যদিকে এক এক পত্রিকার লক্ষাধিক বা হাজার হাজার প্রচারসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে আর কমে যাচ্ছে ৮/১২/১৬/২০ ও ২৪ পৃষ্ঠার বিদেশি কাগজে ছাপা কলেবরও। বিদেশ থেকে কাগজ আমদানিও বন্ধ হয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন শতভাগ লোকসান দিয়ে কতদিন এই প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারবেন? সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সহ সারা দেশে সংবাদপত্রে কর্মরত হাজার হাজার সাংবাদিক-কর্মচারী ও সংবাদকর্মীর জীবন এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটছে। চলতি মার্চ মাস শেষ হলেই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই বেতনের দিন আসবে। কীভাবে পরিশোধ হবে তাদের বেতন? ইতিমধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান মহানুভব হয়ে সাংবাদিক-সংবাদকর্মীদের অগ্রিম বেতন দিয়ে নজির স্থাপন করেছেন। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠান গত ফ্রেব্রুয়ারি মাসের বেতনই দেন নাই। তবে বেশিরভাগই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত।
সোস্যাল মিডিয়া সমাজে গুজব ও অস্থিরতা ছড়ালে তার দায়-দায়িত্বই বা কে নেবে? পাঠকরা তো আর সংবাদ থেকে বঞ্চিত থাকবেন না। তারা টিভি, অনলাইন ও অন্যান্য সূত্র থেকে দিনের পর দিন সংবাদ পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে, পরে তারা কি আর মুদ্রণ সংবাদপত্রের প্রতি আকৃষ্ট হবেন? পাঠকের এই মনেবৃত্তির পরে পত্রিকাগুলো কী তাদের হারানো প্রচারসংখ্যা ফিরে পাবে? বিষয়গুলো নিয়ে এখনই সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে পারলে এবং সরকারের সহায়তা হাত প্রসারিত না করলে দেশের নতুন করে আরও একটি বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে।
দেশের এই অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তৈরি পোশাক ও রফতানি শিল্পের জন্য ইতিমধ্যেই ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। শহর ও গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও শ্রমজীবী বেকার মানুষদের জন্য সরকার ১০ টাকায় চাল দেওয়াসহ আগামী ৬ মাসের খাবার (ভিজিএফ) সরবরাহ করছে। শহর ও গ্রামে কোয়ারেন্টাইনে থাকা পরিবারগুলোকেও প্রশাসন থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। আরও বহু প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন স্বপ্রণোদিত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসহায়-গরিব ও দুস্থ পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে উদাহরণ সৃষ্টি করছেন। এ অবস্থায় দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে খ্যাত সংবাদপত্র শিল্পকে বাঁচাতে এখনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সংকট উত্তরণের পথ হিসেবে আপতদৃষ্টিতে বলা যায়, সরকারি-বেসরকারি অফিসে ও ডিএফপিতে সংবাদপত্রের যে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন (ক্রোড়পত্র) বিল বকেয়া পড়ে আছে, সেগুলো জরুরি ভিত্তিতে পরিশোধ করলে হয়তোবা কিছুটা রেহাই পাবে সংবাদপত্রগুলো। মফস্বলের সরকারি অফিসগুলোর সংবাদপত্রের বিলও যাতে এপ্রিল মাসের মধ্যে পরিশোধ করা হয়, তার জন্য বিশেষ নির্দেশনাও কামনা করছি। একই সঙ্গে জাতির পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরি, সাংবাদিকবান্ধব, মানবতার প্রতীক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই শিল্পের প্রণোদনা হিসেবে একটি বিশেষ থোক বরাদ্দ দিয়ে সংবাদপত্র শিল্পের হাজার হাজার গনমাধ্যমকর্মীর অন্ধকার ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা জ্বালানোর জন্য গনমাধ্যমকর্মীদের পক্ষ থেকে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। বিশেষ করে তাদের পরিবার পরিজনের কথা ভেবে, কারন তারা কারো কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নিতে পারে না, অথচ সমাজের বিত্তবানরা জানে তারা সাংবাদিক পরিবার। তাদের কোন অভাব নাই, তারা অনেক টাকা বেতন পায়। বাস্তবে সবই তার উল্টো। তাই গনমাধ্যম কর্মীদের বকেয়া ও অগ্রিম বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা একটি মানবিক দাবী।
তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে বিজ্ঞাপন বণ্টন ও বিল পরিশোধে যে নৈরাজ্য, সিন্ডিকেট ও অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে সেগুলোও বিশেষ দৃষ্টি নিয়ে দূর করতে হবে। সংবাদপত্রের মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেও উদ্ভাবন করা যেতে পারে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র শিল্পের সংকট উত্তরণের মসৃণ পথ। তাহলেই হয়তো দেশের সংবাদপত্র শিল্পে আবারও ফিরে আসবে সেই সুদিন।
লেখক, সাংবাদিক ও সিনিয়র সহ-সভাপতি
ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব
আপনার মতামত লিখুন........