মোঃ নজরুল ইসলাম সুজনঃ পরনে অবিকল পুলিশের পোশাক। হাতে অস্ত্র আর ওয়াকিটকিও। অনেকের হাতে আবার ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যাল লাইট। দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই এরা আসল না নকল। তবে এরা অনেকে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বড় ধরনের অপরাধ ঘটাতে পারদর্শী। বুধবার সিদ্ধিরগঞ্জে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে রহমত উল্লাহ (৩৬) নামে এক ভুয়া পুলিশ স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হয়েছে। পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।এ সময় পুলিশ তার কাছ থেকে একটি ওয়াকিটকি এবং তাঁর মুঠোফোনে ডিএমপি ও জেলা পুলিশের পোশাক পড়া কয়েকটি ছবি উদ্ধার করে।
এর আগে লিংক রোডে, ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রূপগঞ্জে পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই-ডাকাতি করতে গিয়ে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। গত ১১ মাসে সাতটি ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে নয়জন । বিভিন্ন অপরাধ ঘটাতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জে আসল পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে অনেক ভুয়া পুলিশ। আবার অনেক ভুয়া পুলিশকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনাও ঘটেছে।
গত ৪ জানুয়ারি। বেলা ২টা ৪৫ মিনিট। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের নম পার্ক থেকে সামান্য দূরে। এক ভদ্রলোক ড্রাইভারের সাথে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন ঢাকার উদ্দেশে। হঠাৎ চারজন লোক গাড়িটি ঘিরে ধরেন, তাদের কারো হাতে ওয়াকিটকি, কারো পরনে পুলিশের পোশাক। তারা নিজেদের পুলিশের সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে লোকটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নেন। দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করে গাড়িটি। পথে গাড়ির ভেতরই শুরু হয় তাদের ধস্তাধস্তি। বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে গাড়িটি লিংক রোডের ভুইগড় পৌঁছতেই দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সেই সাথে গাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসে ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ চিৎকার। তার চিৎকারে পুলিশ পরিচয়ধারী লোকগুলো তাদের ওয়াকিটকি-পিস্তল ফেলেই পালিয়ে যায়। তবে এ সময় স্থানীয়রা আটক করতে সক্ষম হয় পুলিশের পোশাক পরিহিত শামীম নামের এক যুবককে। জনতা গণধোলই দেয় ওই যুবককে। ফতুল্লা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে জানতে পারে, এরা ভুয়া পুলিশ। পরে থানায় নিয়মিত মামলা হয়।
এর এক দিন পরই ৬ জানুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি এলাকায় পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির সময় নারায়ণগঞ্জে বসবাসকারী দুই যুবকসহ তিনজনকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃত দুইজন হলেন, ফতুল্লার জাহাঙ্গীর আলম (৩৮) ও সিদ্ধিরগঞ্জের রিপন মিয়া (৪৬)। গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে পুলিশ পরিচয়ের ভুয়া আইডি কার্ড উদ্ধার করে ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কুটুম্বপুর এলাকায় পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনায় তিনজনকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয় স্থানীয়রা। তিনজনের মধ্যে দুইজন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জের। আর অন্যজন হলো কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার রায়পুর গ্রামের বারেক মিয়া (৫০)।
এ সময় তাদের একজনের কাছ থেকে একটি পুলিশের ভুয়া আইডি কার্ড উদ্ধার করে। ওই আইডি কার্ডধারীর ছবিতে অতিরিক্ত আইজিপির র্যাংক ব্যাজ থাকলেও পদবিতে উপপরিদর্শক লেখা রয়েছে। এই চক্রটি দীর্ঘ দিন মহাসড়কে ছিনতাই ও ডাকাতি করছে।
গত ৮ জানুয়ারি রূপগঞ্জের ভুলতা গাউছিয়া এলাকায় ফ্যাফকন টেক্সটাইল নামক একটি প্রতিষ্ঠানের দু’জন কর্মকর্তা ও চালক ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার পথে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একদল ছিনতাইকারী অস্ত্র ঠেকিয়ে ৩৯ লাখ টাকাসহ প্রাইভেট কার ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ৭ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকা থেকে মো: আলমগীর খাঁ নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, সে নিজেকে সেনাবাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে গত ২৫ ডিসেম্বর ও ৩০ ডিসেম্বর দুই দফা দুই বোনকে ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে হত্যার চেষ্টা করে।
৮ জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জে দুই বোনকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা এবং ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত আসামি মো. আলমগীর খাঁকে (২৫) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১১।
জানা যায়, তিনি সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে মিথ্যা পরিচয়ে ফেসবুক আইডি খুলে ভিকটিমদের সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে তুলেন। ২৫ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার আসামি ভিকটিমের বাড়িতে কৌশলে অবস্থান করেন।পরে কৌশলে ভিকটিমের বিভিন্ন আপত্তিকর ছবি তার মোবাইলে ধারণ করেন এবং ধর্ষণের চেষ্টা করে। আসামি বিভিন্ন সময়ে ভিকটিমদের ভয়ভীতি ও হুমকি দেন এবং ভিকটিমের আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তার বিভিন্ন দাবি পূরণে বাধ্য করেন।
গত ৯ জানুয়ারি সোনারগাঁও থেকে ডিবি পরিচয়ে ট্রাকসহ ৩৭টি গরু ছিনতাই করা হয়।
গত ১২ জানুয়ারি র্যাব পরিচয়ে ডাকাতির অভিযোগে ফতুল্লার ভুইঘড় থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় দেয়া রাশেদুল আলমকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
১৪ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড ভুয়া র্যাব সন্দেহে তিন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয়রা। পরে র্যাব-১০ এসে তাদের নিয়ে যায়।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ফতুল্লা থানার ওসি আসলাম হোসেন জানান, একটি সিগেরেট কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজারকে র্যাব পরিচয় দিয়ে তুলে নেয়ার চেষ্টাকালে স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ হয়; পরে তাদের গণপিটুনি দিয়ে র্যাবের কাছে হস্তান্তর করে।
(২৮ জুন) দুপুরে সদর উপজেলার ফতুল্লা পাগলা বাজার এলাকায় সেনাসদস্য ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে আফজাল মিনহাজ সংগ্রাম (৪৮) নামে এক প্রতারককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এসময় পুলিশ তার কাছ থেকে একটি ভুয়া আইডি কার্ড ও লাঠি জব্দ করে
(১১ নভেম্বর) সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে রহমত উল্লাহ (৩৬) নামে এক ভুয়া পুলিশ স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হয়েছে। পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।এ সময় পুলিশ তার কাছ থেকে একটি ওয়াকিটকি এবং তাঁর মুঠোফোনে ডিএমপি ও জেলা পুলিশের পোশাক পড়া কয়েকটি ছবি উদ্ধার করে।
রহমত উল্লাহ ছিন্নমূল শিশুদের লেখাপড়ার পরিচালনা করার দায়িত্বে আছেন এবং ওই স্কুলের সাহায্যের নামে তিনি নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মন্ডলের নিকট চাঁদাবাজি করতে গেলে এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তাকে আটক করে। পরে তাকে আসল পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত রহমতউল্লাহ ঝালকাঠি জেলার সদর থানার ডাক্তারপট্টি এলাকার মৃত কবির উদ্দিনের ছেলে। সে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার তক্কার মাঠ এলাকার তৈয়বুর রহমানের বাড়ির ভাড়াটিয়া।
২৫ আগষ্ট ২০১৯ সালে র্যাব পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে ৩ প্রতারককে গ্রেফতার করে র্যাব-১১ এর সদস্যরা। রূপগঞ্জের রূপসী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো- কুড়িগ্রাম জেলার উকিলপুর থানার মাসতীবাড়ী দীঘর এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে জয়নাল আবেদীন (২৭), গাজীপুর জেলার সদর থানার জান্দালিয়া পাড়া এলাকার মৃত মুসলেম উদ্দিনের ছেলে নাজমুল হোসেন (২৭) ও কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার চরজাকারিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান (২৯)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ইউনিফর্ম পরিহিত ২টি ছবি (এডিটিং করা), বাংলাদেশ র্যাব লেখা ও র্যাবের মনোগ্রাম সম্বলিত ১টি জ্যাকেট, র্যাব সদর দপ্তরের ভুয়া সীল ও অফিসারদের ভুয়া স্বাক্ষরসহ ৭টি নোটিশ, র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা অফিসার, ডিউটি অফিসার ও তদন্তকারী অফিসার নামীয় ৪টি ভুয়া সীল, বিজিবির ১টি আইডি কার্ড, বিজিবির ১ সেট ইউনিফর্ম, ১টি ল্যাপটপ, ১টি প্রিন্টার, ১টি মোবাইল ও ১৪টি সীম কার্ড জব্দ করা হয়।
১১ জুন ২০১৮ সালে রূপগঞ্জে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সময় দুই ভুয়া ডিবি পুলিশকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কাঞ্চন-কুড়িল বিশ্বরোড (৩শ’ ফুট) সড়কের ভোলানাথপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো, উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের মাহনা এলাকার মৃত আব্দুস সাত্তারের ছেলে আহম্মদ ও আড়াইহাজারের কুমারপাড়া এলাকার ফজলুল হকের ছেলে রায়হান।
৩ অক্টোবর ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডে অভিযান চালিয়ে ভুয়া এএসপি পরিচয়দানকারী ভুয়া এএসপি পরিচয় দেয়া সজিবকে (২৯) নামে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
এ সময় সজিবের কাছ থেকে একটি ভুয়া পুলিশ আইডি কার্ড, বিপুল পরিমাণ পুলিশের ভিজিটিং কার্ড, পুলিশ ও র্যাবের ইউনিফর্ম পরিহিত ছবি উদ্ধার করা হয়। এছাড়া এএসপি সজিব নাম সম্বলিত পরিচয়দানকারী দাওয়াত কার্ড ও ৩ টি মোবাইল ফোনও উদ্ধার করা হয়।
৬ আগস্ট ২০১৭ সালে রূপগঞ্জে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে অটোরিকশা ছিনতাইকালে আবু সাঈদ (৩৫) নামের একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উপজেলার এশিয়ান হাইওয়ে (বাইপাস) সড়কের লালমাটি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আবু সাঈদ বরিশালের কোতোয়ালী থানার দক্ষিণ আলেককান্দা গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের ছেলে।
১ মার্চ ২০১৭ সালে সোনারগাঁর মোগরাপাড়া চৌরাস্তা এলাকা থেকে দুটি প্রাইভেটকারসহ ১০ ভুয়া ডিবি পুলিশকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলোথ নূর ইসলাম, নুরুজ্জামান, মোক্তার, কুদ্দুস, হেলাল, মোজাম্মেল হোসেন, মনির হোসেন, মাসুদ রানা, এনামুল হক, মাসুদ করিম ও মিঠু খান। এ ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় মামলা করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, ৬৫ লাখ টাকা ছিনতাই হবেথ এমন সংবাদের ভিত্তিতে সোনারগাঁ থানা পুলিশ মোগরাপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় লিজা পাম্পের সামনে ডিবি পুলিশের পোশাক পরে ও রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালানো হয়। এ সময় ১০ ভুয়া ডিবি পুলিশকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম জানান , ভুয়া পুলিশ ও ডিবি ধরতে আমাদের সাদা পোষাক পরিহিত পুলিশ সর্বদা কাজ করছে। যদি এমন কোন ব্যক্তি সাধারন মানুষের নজরে আসে তাহলে তাৎক্ষনিক আমাদেরকে ফোন দিলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।
আপনার মতামত লিখুন........